ফিরে দেখাঃ গৌরবোজ্জ্বল অর্ধশতকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
ডঃ কৌশিক ঘোষ
স্বাধীনতা দিবস নিয়ে বিভ্রান্তি দূরীকরণ
স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিক থেকে বাংলাদেশ আমাদের থেকে প্রায় সিকি শতাব্দীর (২৪ বছর) ছোট। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ না কি ১৬ই ডিসেম্বর? সে নিয়ে ভারতীয় ছাত্র ছাত্রীদের একাংশের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি আছে। আসলে যেভাবে ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল আর বাংলাদেশ যেভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের হাত থেকে ক্ষমতা দখল করেছিল, এই দুটোর মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য আছে, আর ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে বিভ্রান্তিটা ঘটে সে জন্যেই। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ব্রিটিশরা যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করে ভারত ছেড়ে চলে যায়, তখনই ভারত স্বাধীন হয়ে যায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ঘোষণার প্রেক্ষিতটা একটু আলাদা। ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের নির্বাচনে (ভারতের লোকসভার সমতুল্য) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভের পর (মোট ৩০০টি আসনে নির্বাচন হয়েছিল, যার মধ্যে আওয়ামী লীগ জিতেছিল ১৬০টি আসন এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেয়েছিল ৮১টি আসন) আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন প্রধানমন্ত্রী পদে ডাক পাবার অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন, তখনই একদিন তিনি এবং তাঁর দল টের পেলেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান (সামরিক ব্যক্তিত্ব) তাদেরকে সরকার গঠন করতে ডাকবেন না। কেন ইসলামাবাদ তাঁদেরকে সরকার গঠন করতে ডাকবে না, সে প্রসঙ্গ পরবর্তীতেকালে বিস্তারিত ভাবে আমরা আমাদের আলোচনায় অবশ্যই রাখব। আপাতত শুধু এটুকু জেনে রাখাটা জরুরী যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর বিভিন্ন কারণে (যে কারণগুলো পরবর্তীতে আমাদের আলোচনায় বিস্তারিতভাবে আসবে) পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা বুঝে গিয়েছিলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নজরে তাঁরা আর যাই হোন, পাকিস্তানের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক তো ননই এমনকী দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকও নন, বরঞ্চ বলা যেতে পারে, তাদের মানবেতর প্রাণী হিসেবে দেখা হত। এই কারনে, বঙ্গবন্ধু তখন আর কোন উপায় না দেখে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন (সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে)। নতুন রাষ্ট্রের নাম হয় বাংলাদেশ (এই নামটি যদিও ১৯৬৯ সালেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল)। ১০ই এপ্রিল একটি অস্থায়ী সরকারও গঠন করা হয়। এই সরকার অবশ্য শপথ নিয়েছিল ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান খুলনা ডিভিশন)। এই সরকারের নেতৃত্বেই কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনী (যা কিনা মূলতঃ গঠিত হয়েছিল পাক সেনাবাহিনী থেকে দেশের স্বাধীনতার টানে চলে আসা সামরিক ব্যক্তিদের নিয়ে) পাক সেনাবিহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা তো আর ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’ সুলভ ছিলেন না, যে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার সাথে সাথেই পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে তারা সদলবলে চলে যাবেন। বরঞ্চ, বঙ্গবন্ধুকেই তারা তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যান এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রচুর সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অত্যাচার শুরু করেন। পাশাপাশি, বাংলাদেশে সমাজের সকল স্তর থেকে মানুষ দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। তবে সেখানকার এক শ্রেণীর মানুষ (বাঙালী ও অবাঙালী উভয়েই) কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীকেই সমর্থন করতে থাকেন। পরবর্তীতে তাদের নাম দেওয়া হয় রাজাকার। রাজাকার একটি ফারসি শব্দ, যার অর্থ হল ‘স্বেচ্ছাসেবক’। এরপর পাক সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের অত্যাচারে সে দেশে থাকতে না পেরে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশের শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেন। এই শরণার্থীদের বেশীর ভাগই আশ্রয় নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে। দিনের পর দিন, এই শরণার্থীদের থাকা খাওয়ার চাপ ভারতের পক্ষে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধ শেষ করতে উদ্যত হতে হয়। তিনি কিভাবে এই মুক্তিযুদ্ধের অবসানে সদর্থক ভূমিকা রেখেছিলেন, সে প্রসঙ্গও আমরা আনবো পরবর্তী কিস্তিগুলিতে। তবে এখানে শুধু জানিয়ে রাখি যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যখন এই পরিস্থিতি চলছিল, তখন বহু ঘটনার মিথষ্ক্রিয়ায় এক বিশেষ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এবং ১৩ দিন যুদ্ধ চলার পর ১৪ দিনের মাথায় পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট-জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি ভারতের জেনারেল জগজিত সিং অরোরার কাছে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেন। এই যে ১৬ই ডিসেম্বর, পাক সেনাবিহিনী ভারতের জেনারেল জগজিত সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করলেন, সেই দিন থেকে কিন্তু বাংলাদেশ পাক সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্তিলাভ করে, বা বলা যেতে পারে প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করে। তাই এই দিনটিকে বাংলাদেশে ‘বিজয় দিবস’ বলে উদযাপন করা হয়। এটিই হল ২৬শে মার্চ ও ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যেকার পার্থক্য।
পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলার ভৌগোলিক আয়তন, জনসংখ্যা এবং বঞ্চনা
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট যখন ধর্মের ভিত্তিতে ব্রিটিশরা ভারত ভাগ করে চলে গেল তখন মনে করা হয়েছিল যে, পাকিস্তান তো ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত হল, তাই এখানে পুরোপুরি শান্তি বিরাজ করবে এখন থেকে। আমাদের ভারতের মত পাকিস্তানও ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থার অনুকরণে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালু করল এবং ভারতের মতই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলল। সেই সময় পাকিস্তানে গভর্নরের প্রদেশ (Province) হিসেবে ৪টি প্রদেশের পরিচিতি ছিল। পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং পূর্ব বাংলা (১৯৫৫ সালে অবশ্য পূর্ব বাংলার অবসান ঘটানো হয় এবং ১৯৫৬ সালের ২৩শে মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তান নামে এই অঞ্চলটির নামকরণ করা হয়)। আর ছিল চীফ কমিশনারের প্রদেশ বলে পরিচিত বালুচিস্তান। ওপরের মানচিত্র থেকে পরিষ্কার যে পাকিস্তানের দু’টি অংশ — পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্যে দূরত্ব ছিল বিরাট। সড়কপথে প্রায় ১৯৩০ কিমি এবং জলপথে প্রায় ১১২৬ কিমি। যখন ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল, তখন এটা ভাবাই হয়নি যে করাচী (১৯৪৭ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত করাচীই ছিল পাকিস্তানের রাজধানী) কিভাবে এত দূরে অবস্থিত পূর্ব বাংলাকে প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? বস্তুতঃ দুই অঞ্চলের লোকেদের ধর্ম ছাড়া আর কোন মিল ছিল না বললেই চলে। তারা আলাদা ভাষায় কথা বলত, খাবারের রকম ভিন্ন প্রকৃতির ছিল, তাদের সঙ্গীত-সংস্কৃতি আলাদা ছিল, পোশাকেও ছিল না কোনো মিল। এবং এই কারণে পাকিস্তান সরকার সব সময় চাইত সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক — সকল ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার লোককে কিভাবে শোষণ, বঞ্চনা ও হেয় করা যায়। সে জন্যে কেউ কেউ বলেন যে, ব্রিটিশদের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে পূর্ব বাংলার লোকেরা এক নতুন ‘অভ্যন্তরীণ সাম্রাজ্যবাদী’ শক্তির হাতে গিয়ে পড়েন। ওপরের মানচিত্রটি থেকে এটা আরও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, আয়তনে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ পূর্ব অংশ অপেক্ষা অনেক বড় ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের আয়তন ছিল প্রায় ৮, ৮১, ৯১৩ বর্গ কিমি এবং পূর্ব বাংলার আয়তন ছিল প্রায় ১, ৪৭, ৫৭০ বর্গ কিমি। অর্থাৎ আয়তনের দিক দিয়ে পশ্চিম অংশ প্রায় ৬গুন বড় ছিল। কাজেই সাধারণভাবে যে কোন লোকের এই ধারণা হতেই পারে যে, পশ্চিম অংশেই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক বসবাস করতেন। অন্যদিকে বাস্তব ছিল ঠিক তার উলটো। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ লোক বাস করতেন পূর্ব বাংলায় এবং ৪৪ শতাংশ লোক বাস করতেন পশ্চিম অংশে। কৃষি থেকে আরম্ভ করে প্রায় সমস্ত অর্থনৈতিক বিষয়ে পশ্চিম অঞ্চল থেকে অনেক এগিয়ে ছিল পূর্ব। তবে পাকিস্তানের জন্মলগ্নে যে ভাষায় রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক কথা বলতেন, সেই বাংলা ভাষাকে কি রকম মর্যাদা দিয়েছিলেন জিন্নাহ এবং তাঁর উত্তরসূরীরা? পাকিস্তানের রাজনীতিতেই বা পূর্ব বাংলার লোকেরা কিরকম গুরুত্ব পেতেন? তাদের প্রথম ক্যাবিনেটে ক’জন পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ছিলেন? স্বাধীনতার পর মাথাপিছু আয়কে নির্ধারক ধরলে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের মধ্যে কাদের বেশী উন্নতি চোখে পড়েছে? দেশের মোট রপ্তানীর সিংহভাগ কোন অঞ্চল থেকে হত? প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের টাকা বেশী পরিমাণে কোন অঞ্চলে খরচ করা হত? সরকারী চাকুরীতে বা সামরিক বাহিনীতেই বা কোথাকার লোকেরা আধিপত্য বিস্তার করত? এই সকল প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে আগামী সংখ্যাগুলোতে।
লেখক, বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক
ক্রমশ…