ডুয়ার্সের হারিয়ে যাওয়া এয়ারপোর্ট

বাংলাডেস্ক, টি.এন.আই, বানারহাট, ১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২২: বর্তমান প্রজন্ম হয়তো অবাক হবে জেনে যে, জলপাইগুড়ি জেলার একসময়ের জমজমাট একটি বিমানবন্দর ছিল, যা এখন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। একদা যেখান থেকে কলকাতা পর্যন্ত নিয়মিত চলত প্লেন, এখান তা ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ; হাতি, চিতাবাঘ, বাইসনের নিরাপদ বিচরণভূমিতে পরিণত হয়েছে। ডুয়ার্সে চা বাগান গড়ে ওঠা শুরু হওয়ার পর প্রত্যন্ত এই অঞ্চলের সাথে বাইরের দুনিয়ার নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে এবং চা শিল্পের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের যাতায়াতের জন্য বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে জলপাইগুড়ি জেলায় বিমান পরিসেবা শুরু হয়েছিল। চা  রপ্তানি করার পাশাপাশি স্থানীয় ব্যবসায়ী ও জেলার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এই বিমানবন্দর থেকে প্লেনে কলকাতা যাতায়াত করতেন। শুনে অসম্ভব মনে হলেও এমনই একটি বিমানবন্দর একসময় ছিল জলপাইগুড়ি জেলাতেই। জায়গাটি বানারহাট শহরের সাথে লাগোয়া এলাকায়। বানারহাট ব্লকের মোরাঘাট চা বাগান মৌজার জমিতে গড়ে উঠেছিল এই ‘তেলিপাড়া এয়ারফিল্ড’। এই জমির পাশেই এখন তৈরি হয়েছে বানারহাট কার্তিক ওঁরাও হিন্দি কলেজ।

জানা যায় গুজরাতের ‘নওয়ানগর’ স্টেটের মহারাজা জামসাহেব দিগ্বিজয় সিংজী রঞ্জিৎ সিংজী জাদেজা’র আর্থিক আনুকুল্যে ১৯৪৬ সালে আমেরিকান বংশোদ্ভূত পাইলট জেমস বি মফ এবং অ্যাংলো-চাইনিজ বংশোদ্ভূত রেডিও ইঞ্জিনিয়ার এডিই কুইন তাদের তিন বন্ধুর সাথে জামএয়ার (Jamair) এয়ারলাইনটির সূচনা করেন। পরবর্তীতে জামনগর থেকে এই এয়ারলাইন সংস্থাটি তাদের হেডঅফিস কলকাতাতে স্থানান্তর করে। মোরাঘাট চা বাগানের থেকে জমি লিজ নিয়ে জামএয়ার কোম্পানি সেখানে একটি এয়ারস্ট্রিপ গড়ে তুলেছিল যা ‘নিউ তেলিপাড়া এয়ারপোর্ট’ নামে পরিচিত ছিল। ছোট বিমান ওঠানামার উপযোগী রানওয়ের পাশাপাশি এখানে ছিল অফিস ও দোতালা এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের টাওয়ার, প্লেন রাখার হ্যাঙ্গার, পাইলট ও টেকনিশিয়ানদের জন্য রেস্ট রুম। চা শিল্পের সোনালী দিনে প্রতিদিন কলকাতা থেকে উড়ে আসত প্লেন। আমেরিকান কোম্পানি ডগলাস এর দুই জন চালক বিশিষ্ট প্রায় ৩২ জন যাত্রী অথবা ২৭০০ কেজি কার্গো পরিবহনে সক্ষম ডিসি-থ্রি এবং প্রায় ৫২ জন যাত্রী পরিবহনে সক্ষম ডিসি-ফোর মডেলের বিমানগুলি এই বিমানঘাটি থেকে উড়লেও এগুলিতে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছিল। তেলিপাড়া বিমানবন্দরে আসা বিমানগুলি মূলত কার্গো বহনের জন্য ব্যবহৃত হলেও এই বিমানেরই ডান দিকের কিছুটা অংশে কয়েকটি চেয়ারও লাগানো থাকত। ফলে চিঠিপত্র, চা পাতা ও অন্যান্য সামগ্রী পরিবহনের পাশাপাশি অল্পসংখ্যক যাত্রীও নিয়মিত একই প্লেনে যাতায়াত করতেন। ৩১সি জাতীয় সড়ক তখনো গড়ে না ওঠায়, এই বিমান পরিসেবাই ছিল জলপাইগুড়ি জেলা ও ডুয়ার্সে বসবাসকারীরা মানুষদের ভরসা। অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলায় এমনই আরও ৯টি বিমানবন্দর ছিল। স্বল্প মূল্যে বিমান পরিসেবা উপভোগ করার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসপত্রও প্লেনে আমদানি করা হত। সেই সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক খবরের কাগজ শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি শহরে ট্রেনে করে পৌঁছতে বিকেল কিম্বা পরের দিন সকাল হয়ে যেত। শহুরে মানুষেরা একদিনের বাসি কাগজ হাতে পেলেও, ডুয়ার্সের বিভিন্ন শহর ও ছোটখাটো জনপদের বাসিন্দারা এই বিমান পরিসেবার দৌলতে সকাল ১০টার মধ্যেই কলকাতায় ছাপা গরমাগরম খবরের কাগজ হাতে পেয়ে যেতেন। সময়ের সাথে তাল মিলাতে না পেরে ১৯৭৭ সালে এই বিমান পরিসেবা বন্ধ হয়ে যায়।

 

Facebook Comments
Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!