ফিরে দেখাঃ গৌরবোজ্জ্বল অর্ধশতকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

পূর্ব প্রকাশিতের পর …

ডঃ কৌশিক ঘোষ

‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা- না উর্দু?’

স্বাধীনতার পর পূর্ব বাংলার লোকেদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান

ধর্ম বড়, না কি ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস — এগুলোই বড়? পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কিন্তু ধর্মের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাসের মত বিষয়গুলো। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম কারণ ছিল বাংলা ভাষার অপমান। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক — সকল ক্ষেত্রে পূর্ব বঙ্গে বাঙালীদের হেয় করা, হীন প্রতিপন্ন করা ইত্যাদি। তবে অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চিম পাকিস্তান ছিল পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিম পাকিস্তান যে ১৯৭১ সালে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যে কোন মুল্যেই চাইছিল, পূর্ব পাকিস্তান তাদের সাথেই থাকুক, তাঁর একটা বড় কারণ ছিল, তারা জানত যে, একটা সোনার ডিম পাড়া হাঁস তারা হারাচ্ছে।

এখানে পাঠকের একটি কৌতূহল থাকতে পারে যে, শুধু কি পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের ওপরই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবে শোষণ করত, না কি পশ্চিম পাকিস্তানেরও কোন কোন জাতি বঞ্চনার শিকার ছিল। এর উত্তর হল, স্বাধীনতার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী ও মোহাজিরদের মত একটি দুটি জাতি-গোষ্ঠীই পাকিস্তানের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও সামরিক পদ দখল করে রাখত (স্বাধীনতার পর যে সব মুসলমান স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন, তাদেরকে সেখানে এখনো মোহাজির বলা হয়)। এই জাতি-গোষ্ঠীগুলো পশ্চিম পাকিস্তানের বালুচ, পাঠান ও সিন্ধীদের কে সব সময় বঞ্চিত করতে চাইত (একটি হিসেবে এটা উঠে এসেছে যে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে পাকিস্তানের মোট ২৭ জন গভর্নর জেনারেল / রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রাদেশিক গভর্নর ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ১৮জনই মোহাজির ছিলেন)। এরই মধ্যে ১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের শাসকরা পশ্চিম পাকিস্তানের তিনটি প্রদেশকে, যথাক্রমে পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে আলাদা আলাদা প্রদেশের মর্যাদা থেকে সরিয়ে একটি ইউনিটে পরিণত করেন। এই ‘এক ইউনিট ব্যবস্থা’ কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাবী ও মোহাজিরদের শক্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল কারণ যে বাংলা ভাষার অপমান ছিল, সে কথা আমরা আগেই জেনেছি। স্বাধীনতার ঠিক পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা নিয়ম করে বাংলা ভাষাকে অপমান করত। পাঠকরা হয়ত এটা জানলে এতটুকু আশ্চর্য হবেন না যে, এর সূত্রপাত কিন্তু জিন্নাহর হাত ধরে এবং স্বাধীনতার অনেক আগে থাকতেই। ১৯৩৭ সালেই তৎকালীন মুসলিম লীগের সভাপতি জিন্নাহ চেয়েছিলেন যে, উর্দুকে মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হোক। তবে সে যাত্রায় এ. কে. ফজলুল হকের প্রবল বিরোধিতায় সে সিদ্ধান্ত তিনি কার্যকর করতে পারেননি। আসলে আমরা যদি আরও ৪ বছর পিছিয়ে যাই, তাহলে দেখব যে, “পাকিস্তান”— এই কথাটির সাথে পূর্ব বঙ্গের কোনো যোগই ছিল না।

চৌধুরী রহমত আলীর প্রস্তাবিত পাকিস্তান মানচিত্রের আংশিক রূপ

১৯৩৩ সালে যখন চৌধুরী রহমত আলী প্রথম আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রস্তাব সবার সামনে পেশ করেন, তখন পূর্ব বঙ্গের এই অঞ্চলকে কিন্তু প্রস্তাবিত পাকিস্তানের অংশ বলে দেখানোই হয়নি। এই অংশকে মুসলিম অধ্যুষিত ‘বাঙ্গিস্তান’ বলে দেখানো হয়েছিল। অর্থাৎ, ধর্ম এক হলেও এই অঞ্চলকে পাকিস্তানের বাইরেই রেখেছিলেন চৌধুরী রহমত আলী। তাই, বাঙালীদেরকে নিজেদের বলে না ভাবা কোন নতুন ধারা নয় পাকিস্তানে। “পাকিস্তান” নামক ভাবনা চিন্তার শুরু থেকেই বাঙালীদের স্থান বাইরেই ছিল। এ প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। স্বাধীনতার ঠিক আগ দিয়ে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য ডঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ বহু ভাষাভাষীর দেশ হবু পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে উর্দুর হয়ে সওয়াল করেন। তিনি বলেন, ভারত যেমন নতুন রাষ্ট্রের রাজ ভাষা হিসেবে হিন্দির কথা ভাবছে, সেভাবেই পাকিস্তানেরও উর্দুর কথা ভাবা উচিত। তবে তিনি চালাকি করে যে সত্যটি গোপন করেছিলেন, সেটি হল, ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দিতে কথা বলেন। অন্যদিকে পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ভাষা ছিল বাংলা। ঠিক এই জায়গাটিতেই আলিগড়ের উপাচার্যকে আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবি ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ‘ডেইলি আজাদ’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন ১৯৪৭ সালের ২৯শে জুলাই। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’। সেখানে তিনি পরিষ্কার লেখেন – বাংলার বদলে অফিস আদালতে ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উর্দুর ব্যবহার শুরু হলে, তা হবে রাজনৈতিক দাসত্বের সামিল।

আরো পড়ুন: ফিরে দেখাঃ গৌরবোজ্জ্বল অর্ধশতকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

যদি আমরা স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে কত শতাংশ মানুষ কোন ভাষায় কথা বলতেন, সেই তথ্যে নজর দেই, তাহলে দেখব যে, বাংলা ভাষায় কথা বলতেন ৫৪.৬ শতাংশ মানুষ, পাঞ্জাবী ভাষায় কথা বলতেন ২৮ শতাংশ মানুষ এবং উর্দু ভাষায় কথা বলতেন ৬ শতাংশ মানুষ (এখানে এটা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, মোহাজিরদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক উর্দু ভাষায় কথা বলত)। অর্থাৎ, কোনো যুক্তি পেশ করেই বাংলার রাষ্ট্রভাষা হওয়া আটকান সম্ভব ছিল না পাকিস্তানে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই ডাকটিকিট, রেল ও বিমানের টিকিট, বিভিন্ন সরকারি ফর্ম – সব কিছুতেই বাংলা ছিল অনুপস্থিত। সেগুলো ছাপা হত শুধুমাত্র উর্দু ও ইংরেজি ভাষায়। রাষ্ট্রভাষা না হওয়ার ক্ষোভকে বুকে চেপে রেখে বাঙালীরা প্রথমে দাবী পেশের ও পরে আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করে। প্রথম যে সংগঠনটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল তার নাম ‘তমদ্দুন মজলিস’। ১৯৪৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বর এই সংগঠনটি ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। তমদ্দুন শব্দের অর্থ ‘সংস্কৃতি বা কৃষ্টি’। আর মজলিস শব্দের অর্থ ‘সমিতি বা সঙ্ঘ’। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করা। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে তা করতে গিয়ে কিন্তু এই সংগঠনটি উর্দু ভাষার ধারক – বাহক না হয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ উলটো পথে হেঁটে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দিকে জোর দেয়। এই সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হয়েছিলেন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক আবুল কাশেম।

মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা!

১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর একটি ১৮ পৃষ্ঠার পুস্তিকা তাঁরা প্রকাশ করেন (প্রচ্ছদ সহ ২০ পৃষ্ঠা)। এই পুস্তিকাটির প্রচ্ছদে লেখা ছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা – না উর্দু?’ এই পুস্তিকাটিতে মোট তিনটি লেখা ছিল। প্রথম লেখাটির নাম ছিল ‘আমাদের প্রস্তাব’ (মজলিসের পক্ষ থেকে লিখিত), দ্বিতীয় লেখাটির নাম ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব – পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’। এটির লেখক ছিলেন অধ্যাপক কাজী মোতাহের হোসেন এবং তৃতীয় লেখাটির নাম ছিল ‘বাংলাই আমাদের রাষ্ট্র – ভাষা হইবে’। এটির লেখক ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। আসলে, ভাষার স্বীকৃতি না দেওয়া কিন্তু শুধুমাত্রই ভাষার অপমান ছিল না। কায়দা করে আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে বাঙালী জাতিকে পিছিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের। উর্দু একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেলে, যারা উর্দু জানবে না তারা পড়াশোনা ও চাকরিতে পিছিয়ে পড়বে। যে ‘অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতাবাদ’ পশ্চিম পাকিস্তান শুরু করেছিল, তার ষোলকলা পূর্ণ হবে। এই পুস্তিকাটিতে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ছিল।

সেই বছরেরই ২৭শে নভেম্বর থেকে ১লা ডিসেম্বর পর্যন্ত গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর পৃষ্ঠপোষকতায় ও পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে রাজধানী করাচীতে অনুষ্ঠিত হয় ‘শিক্ষা সম্মেলন’। এ প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ করা খুবই জরুরী যে, ফজলুর রহমান কিন্তু বাঙালী ছিলেন। এই সম্মেলনে অনেক প্রস্তাবের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব এটাও নেওয়া হয় যে, উর্দু ভাষাকেই পাকিস্তানের ‘lingua franca’- এর স্বীকৃতি দেওয়া হবে অর্থাৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু। ‘Lingua Franca’- এর অর্থ হল, কোন রাষ্ট্রে যদি বহু ভাষাভাষীর মানুষ থাকেন, তাহলে একটি ভাষাকে যোগাযোগের প্রধান ভাষা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। পাকিস্তানের তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান এই ঘোষণা দেবার সাথে সাথে পূর্ব বঙ্গ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।

লেখক, বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক

ক্রমশ…

Facebook Comments
Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!