সিল্করুটের পাহাড়ি পথ বেয়ে . . .
কৌশিক চট্টোপাধ্যায়
পাহাড়ি পথের বাঁক বেয়ে চলতে চলতে কখন যে দুচোখ লেগে এসেছিলো বুঝতেই পারিনি। ঘ্যাঁচ করে একটা ব্রেক করার আওয়াজে চোখ খুলতেই চোখের সামনে পথ আগলে দাঁড়িয়ে স্বয়ং দুটো চমড়ি গাই। গাড়ির ঝাপসা কাঁচটা একটু নামিয়ে দিতেই ওৎ পেতে বসে থাকা মেঘসেনারা ঝাঁক বেধে ঢুকে পড়লো গাড়ির ভেতরে। মেঘভেজা চোখে তখন স্বর্গীয় অনুভূতি। কালো পিচ রাস্তার দুই পাশে যতদূর চোখ যায় গোটা এলাকা বরফে সাদা। মাথার ওপর সূর্যটা যেনো আজ অনেকটাই কাছে।
ফাদামচেন থেকে সিল্করুটের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে সন্তর্পণে গাড়ি এগিয়ে চলছে কুপুপের উদ্দেশ্যে। এ পথে প্রচুর গাড়ির উপদ্রব নেই তাই বেশ আরামেই এগিয়ে চলা যায়। ‘সিল্করুট’ অর্থাৎ এই রেশম পথের নাম তো অনেক আগেও শুনেছিলাম কিন্তু এ পথে আসা হয়নি কখনো। শিলিগুড়িতে ব্যক্তিগত কিছু কাজ সেরে হাতে দু’তিনদিন সময় পাওয়া গেলো, অমনি মনটা কোথা যাই, কোথা যাই করে উঠতেই সোজা দ্বারস্থ পরিচিত এক ট্রাভেল এজেন্সির। তাদের কাছ থেকেই এই রেশম পথে যাওয়ার যাবতীয় রুট ম্যাপ পাওয়া গেলো। ব্যাস অমনি ঠিক হয়ে গেলো শিলিগুড়ি থেকে চার বন্ধু মিলেই রওনা হলাম রেশম পথের উদ্দেশ্যে। সবজান্তা গুগলের কাছ থেকে জানতে পারলাম, একসময়ে এই পথদিয়েই নাকি ‘চীনা রেশম’ ভারতবর্ষে আমদানি করা হতো এবং ভারতের মধ্যদিয়ে এশিয়া,ইউরোপ এবং আফ্রিকাতে পৌঁছে দেওয়া হতো। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় যে একসময়ে এশিয়া,ইউরোপ এবং আফ্রিকার মধ্যে রেশম বাণিজ্যের জন্য যে ৬৫০০ কিলোমিটারের গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন বানিজ্য নেটওয়ার্ক তৈরি হয়ে ছিলো তার মধ্যে এই রাস্তাটি ছিলো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ। সিকিম গেট রংপো থেকেই ডানদিকে ঘুরে গিয়েছে রাস্তা। সেখান থেকে রংলিতে গিয়ে বিশেষ অনুমতিপত্র জোগাড় করে ঢুকে পড়লাম রেশম পথে। চড়াই উতরাই পথে হাজারো নাম না জানা পাহাড়ি ফুল,রঙিন প্রজাপতি আর একটু একটু করে মেঘের দেশে প্রবেশ করার অপার্থিব আনন্দ। “বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস, এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে, পরাঙ্মুখ সবুজ নালি ঘাস, দুয়ার চেপে ধরে…. “
রংলি বাজার থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ বেয়ে ফাদামচেন পৌঁছতে প্রায় দুই ঘন্টা সময় লেগে গেলো। ছবির মতো ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম । চারিদিকে নাম না জানা পাহাড়ি ফুলের সমাহার। প্রথমদিনের জন্য সেখানেই রাত্রিবাস। সুম্বা শেরপার হোম স্টে’তে টিফিন সেরে হেলিপ্যাডের দিকে পা বাড়ালাম আমরা। কয়েক’শ পরিবারের বসবাস এই গ্রামে। পর্যটকদের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি হোমস্টে। বর্তমানে নাকি সিল্করুট ভ্রমণকারীরা সেন্টার হল্ট হিসেবে ফাদামচেনকেই বেছে নিচ্ছেন। সে জন্য আগে থেকে বুকিং না করে এসে পড়লে সমস্যা হতে পারে।
পরদিন খুব সকালে উঠেই রওনা বিখ্যাত জিগ-জ্যাগ রোড হয়ে কুপুপের উদ্দেশ্যে। রাস্তায় একটা ভিউ পয়েন্টে দাঁড়াতেই বেশ কয়েকজন টুরিস্ট আমাদের সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি জুলুকের পথে রওনা হতে বললেন। আমরাও উৎকণ্ঠা নিয়ে তড়িঘড়ি রওনা দিলাম কুপুপের পথে ।
কিছুটা এগোতেই বাতাসে মেঘের গন্ধ। আচমকাই দেখি গাড়ির কাঁচ ঝাপসা করে দলেদলে ধেয়ে আসছে মেঘসেনারা । ঝাঁপিয়ে পড়ছে গাড়ির কাঁচের ওপর। গাড়ির ওয়াইপার যুদ্ধচালিয়ে যাচ্ছে মেঘ সেনাদের সাথে। অনাবিল আনন্দে কেঁপে উঠছে আমাদের সর্বাঙ্গ । প্রতিটি রোমকূপে জেগে উঠছে অজানাকে গায়ে মেখে নেওয়ার অদ্ভুত অনুভূতি। গাড়ির কাঁচটা সামান্য খুলে দিতেই মেঘসেনারা ঢুকে পড়লো গাড়ির ভেতরে। মেঘসেনাদের হাতে নিজেদের সমর্পণ করতেই একরাশ ভালোবাসায় তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের কোলের ওপর। ভালোবাসায় ভিজিয়ে দিতে দিতে পরম আদরে দুচোখে বুলিয়ে দিলো রূপকথার জাদুকাঠি আর ছুটে চলে গেল অন্য কোনো ভিনদেশীদের অভ্যর্থনার জন্য । চোখমেলে দেখতে পেলাম পীচরাস্তাটা পৌঁছে গেছে অনন্ত মেঘের দেশে। চোখের পলক পরছেনা। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। এ কোন পৃথিবী? রাস্তার দুই পাশে জমাট মেঘের সমুদ্র আর মেঘের সমুদ্র থেকে হাসিমুখে মাথা তুলে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা । পাথুরে মাটি ঢেকে গিয়েছে সাদা বরফে। সাদা বরফ আর জমাট মেঘ মিলেমিশে একাকার। মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলা কালো পিচ রাস্তাটা যেনো আজ মেঘের দেশে হারিয়ে যাওয়ার ঝুলন্ত সেতু।
কিকি দেখবেন: সিল্করুটে চলতে চলতে দেখে নিতে পারেন ওল্ড জিগ-জ্যাক রোডের অপরূপ সৌন্দর্য, জুলুকের পাহাড়ি গ্রাম আর থাম্বি ভিউ পয়েন্ট থেকে চাক্ষুষ করতে পারেন কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য, দেখে নিন ওল্ড বাবা মন্দির। পুরনো বাবা মন্দিরেই জানতে পারবেন বাবা হরভজন সিংএর নানান ভৌতিক কর্মকাণ্ড ,লছমন চক যাওয়ার পথে বরফে মোরা বিস্তীর্ণ ভ্যালিতে বয়স ভুলে গিয়ে মেতে উঠুন বরফ খেলায় , দুচোখে ভরে নিন নাথাংভ্যালি অথবা কুপুপ এলিফ্যান্ট লেকের (যার আরেক নাম মেমেঞ্চলেক)স্বর্গীয় সৌন্দর্যকে। কুপুপ ভ্যালিতে দেখে নিন এশিয়ার সর্বচ্চ গল্ফকোর্স।
কিভাবে যাবেন: সিল্করুট ঘুরতে যাওয়ার আদর্শ সময় অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত । কলকাতা থেকে যে কোন ট্রেনে করে চলে আসুন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে । সেখান থেকে বিভিন্ন রকম প্যাকেজ ট্যুরে দুইরাত তিন দিন অথবা তিন রাত চার দিনের প্যাকেজে জুলুক সহ ঘুরে নিতে পারেন ইচ্ছেগাঁও, আরিতারের মতো আরো বেশ কয়েকটি পাহাড়ি গ্রাম।
কোথায় থাকবেন: সিল্করুটের অধিকাংশ গ্রামগুলিতেই থাকাখাওয়া জন্য অনেকগুলি হোম স্টে’র ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো। প্যাকেজের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ‘ ক্রিম-ইন-অল টেস্ট অ্যান্ড ট্রাভেলসের’ সাথে। ফোন নাম্বার গোপাল বাড়ই – 9474443080 রূপম গুপ্তা – 9733302204