কারা বসবেন মসনদে? কি বলছে ভোটদানের হার
ডঃ কৌশিক ঘোষ
যারা রাজনীতি চর্চা করেন, তারা জানেন যে যখন সরকারের পরিবর্তন ঘটে, সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়, তখন ভোটারদের ভোটদানের হারে এর প্রতিফলন ঘটে। ভোটদানের হার অনেকটাই বেড়ে যায়। যদিও সমাজ বিজ্ঞানের কঠিন শাস্ত্র ভোটদান ধারা–নির্ণায়ক বিদ্যা (Psephology) অনুযায়ী সব সময়ই যে এমনটিই ঘটে, তা নয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এটা লক্ষ্য করা যায়। আজকে যখন চতুর্দিকে এক্সিট পোলের ছড়াছড়ি, তখন আমরা না হয় এই পদ্ধতির মাধ্যমে একটু চোখ বুলিয়ে নেই অতীতে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনেও কি এর প্রতিফলন ঘটেছিল? নাকি, পশ্চিমবঙ্গের ভোটদানের হার দিয়ে কখনোই বোঝা সম্ভব নয়, যে কে আসতে চলেছেন মসনদে। এরই সাথে একবার একটু দেখে নেব যে প্রথম বিধানসভা নির্বাচন থেকে আজকের এই সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা জোট কারা কারা ছিল এই রাজ্যে?
১৯৫২ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের প্রথম বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে রাজ্যের মোট ভোটারের ৪৩.১ শতাংশ মানুষ মোট ২৩৮টি আসনে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। এই ২৩৮টি আসনের মধ্যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ১৫০টি আসন লাভ করে। এই নির্বাচন হয়েছিল ত্রিমুখী। সর্ববৃহৎ শক্তি ছিল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং দু’দিকে ছিল দুই আলাদা আলাদা বাম জোট। প্রথম বাম জোটের নাম ছিল ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট অর্গানাইজেশন অফ ইন্ডিয়া। এর শরিকরা ছিল ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি, সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টি এবং মার্ক্সবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক। অপর বাম জোটটি হল পিপলস ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট ফ্রন্ট। এর শরিকরা ছিল সোশ্যালিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক (রুইকার) এবং ভারতের বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টি।
১৯৫৭ সালে রাজ্যের দ্বিতীয় বিধানসভা নির্বাচনে মোট ভোটারের ৪৭.৬ শতাংশ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। ১৯৫২ সালের মত ১৯৫৭ সালেও জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনে জিততে কোনো অসুবিধে হয়নি। মোট ২৫২ জন জয়ী প্রার্থীর মধ্যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের জয়ী প্রার্থী ছিলেন ১৫২ জন। আগের বারের থেকে ১৪টি আসন বেড়ে যাবার অন্যতম কারণ ছিল ১৯৫৬ সালের ১ লা নভেম্বর রাজ্য পুনর্গঠন আইন অনুযায়ী বিহারের পূর্ণিয়া জেলার কিয়দংশ এবং মানভুম জেলার পুরুলিয়া উপ-জেলাকে (চর থানাকে বাদ দিয়ে) পশ্চিমবঙ্গের হাতে হস্তান্তরিত করা হয়েছিল। তাই বিধানসভার আসনসংখ্যা ১৪টি বেড়ে গিয়েছিল। এই নির্বাচনে মূলতঃ ৪টি প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল। প্রথম পক্ষে ছিল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। দ্বিতীয় পক্ষে ছিল ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল, প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক, মার্ক্সবাদী ফরওয়ার্ড ব্লককে নিয়ে গঠিত ইউনাইটেড লেফট ইলেকশন কমিটি। তৃতীয় পক্ষে ছিল এস ইউ সি আই, বলশেভিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া, রিপাবলিকান পার্টি এবং ডেমোক্র্যাটিক ভ্যানগার্ড দলকে নিয়ে গঠিত ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট।অন্যদিকে চতুর্থ পক্ষে ছিল জনসঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভা ও ভারতের বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টি।
১৯৬২ সালের তৃতীয় বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে বামেদের বৃহত্তর জোট গঠিত হয়। জোটের নাম দেওয়া হয় ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট। এর শরিকরা ছিল ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক, মার্ক্সবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক, ভারতেরবিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টি, বলশেভিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল। অর্থাৎ আগের বারের মত বামেরা তিনটি আলাদা আলাদা জোটের শরিক হয় নি। বেশীর ভাগ বাম দলই ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্টের শরিক হয়েছিল। ১৯৬২ সালের নির্বাচনে মোট ভোটারের ৫৫.৬ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে গিয়েছিলেন এবং জাতীয় কংগ্রেস আগের বারের মতই ব্যাপক সাফল্য লাভ করে। মোট ২৫২টি আসনের মধ্যে ১৫৭টি তে জয়ী হয়ে প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ আসন জয়ের কাছাকাছি পোঁছে গিয়েছিল তারা।
আমরা যে উদ্দেশ্যে এই লেখা লিখছি, তাতে ১৯৬৭ সালে অনুষ্ঠেয় চতুর্থ বিধানসভার নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ১৯৬৭ সালেই পশ্চিমবঙ্গে প্রথম অ-কংগ্রেসী যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের শরিক কারা কারা ছিল? যুক্তফ্রন্টের মূল শরিক ছিল দুটি আলাদা আলাদা জোট, যথাক্রমে, পিপলস ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট [ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি, বাংলা কংগ্রেস, সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লক, ভারতের বলশেভিক পার্টি] এবং ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট [ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী), সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টি, এস ইউ সি আই, মার্ক্সবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক, ভারতের বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টি, ভারতের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল]। যুক্তফ্রন্ট মোট ২৮০টি আসনের মধ্যে ১২৫টি আসন পেয়েছিল।বাংলা কংগ্রেসের অজয় কুমার মুখার্জি পশ্চিমবঙ্গের চতুর্থ ও প্রথম অ-কংগ্রেসী সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তবে অজয় কুমার মুখার্জি কিন্তু পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারেন নি। ১৯৬৭ সালের ২১ শে নভেম্বর দ্বিতীয় বারের জন্যে আবার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, ঘটনাচক্রে যার নামের সাথে জড়িয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর তকমা। তবে তখন তিনি ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধি, এবার অবশ্য তিনি মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের হয়ে। তবে সরকার গঠনের মাত্র তিন মাসের মাথায় এই সরকারের পতন হলে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন শুরু হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালের এই নির্বাচনে ৬৬.১ শতাংশ মানুষ ভোট প্রয়োগ করেছিলেন। যদি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে দেখব যে, আগের বারের বিধানসভা নির্বাচন থেকে ভোটদানের হার বৃদ্ধি পেয়েছিল ১০.৫ শতাংশ।পশ্চিমবঙ্গে এই বৃদ্ধি তখনো পর্যন্ত ছিল সর্বাধিক।
এরপর ১৯৬৯ সালে পঞ্চম বিধানসভার নির্বাচন হলে পুনরায় অজয় কুমার মুখার্জি যুক্তফ্রন্টের তরফে মুখ্যমন্ত্রী হন। তাঁর জোট এই নির্বাচনে ২৮০টি আসনের মধ্যে ২১৪টি আসন লাভ করেছিল। এই নির্বাচনে ৬৬.৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। আগের বারের থেকে ভোটদানের হারের বৃদ্ধি হয়েছিল ০.৪ শতাংশ। যেহেতু আগের সরকারের পতনের সময় সরকারের প্রধান ছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, তাই আমরা বলতেই পারি বাংলার মানুষ এই নির্বাচনেও পরিবর্তনের পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। তবে এই সরকারও অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। মাত্র ১ বছর ১৯ দিনের মাথায় অজয় বাবুর সরকারের পতন ঘটে।
১৯৭১ সালে ষষ্ঠ বিধানসভার নির্বাচনে ৬২.০ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। এই নির্বাচনের পরেও অজয় কুমার মুখার্জি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন। এই নির্বাচনে আগের বারের থেকে ভোটদানের হার কমে গিয়েছিল ৪.৫ শতাংশ। অজয় বাবুর সরকারের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৮৭ দিন। এরপর বেশ কিছুদিন রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন চালু থাকার পর ১৯৭২ সালে সপ্তম বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালের নির্বাচনে সিপিএম এককভাবে সবচেয়ে বেশী আসন পাওয়া সত্ত্বেও (১১৩টি আসন) রাজ্যপাল তাদের সরকার গড়তে না ডাকায়, রাজ্যপালের এই সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করেছিল তারা।
সপ্তম বিধানসভা নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন মোট ৬০.৮ শতাংশ ভোটার। এই নির্বাচনে দুটি মুখ্য জোট ছিল। কংগ্রেস ও সিপিআই একদিকের জোটের প্রধান মুখ ছিল। তাদের জোটের নাম ছিল প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়্যান্স। অন্যদিকে সিপিএমের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল বৃহত্তর বাম জোট। যার শরিকরা ছিল বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল, এসইউসিআই, ভারতের বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টি, মার্ক্সবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক, ওয়ার্কার্স পার্টি অফ ইন্ডিয়া, বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস। এমনকি নির্বাচনের আগে সিপিএম আরেক বাম দল ফরওয়ার্ড ব্লকের সাথেওকিছু আসন সমঝোতা করে নিয়েছিল। তবে সিপিএমের মত অনেকেই এই নির্বাচনকে বিতর্কিত নির্বাচন বলে মনে করে থাকেন। সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বাম জোট রিগিং–সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে নির্বাচনের দিন বেলা ১২ টার মধ্যেই এই নির্বাচন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন। সর্বোপরি সিপিএমের যে প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বিধানসভায় যাননি নির্বাচনে রিগিং হয়েছিল বলে। এই নির্বাচনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ২৮০টি আসনের মধ্যে ২১৬টি আসনে জয়লাভ করেছিল।
আমাদের আলোচনায় ১৯৭৭ সালের অষ্টম বিধানসভা নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৬.২ শতাংশ এবং এই নির্বাচনের পরই গঠিত হয়েছিল প্রথম বামফ্রন্ট সরকার। মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে বামফ্রন্ট দখল করেছিল ২৩১টি। এই নির্বাচনের আরেকটি দ্রষ্টব্য বিষয় হচ্ছে পূর্ববর্তী নির্বাচন থেকে ভোটের হার অনেক কম পরা সত্ত্বেও সরকারের পরিবর্তন হয়। যদি ১৯৭২ সালের নির্বাচনকে বিতর্কিত বলে ধরাও হয় (ভোটদানের হার ৬০.৮ শতাংশ), তাহলেও ১৯৭১ সালের তুলনাতেও (৬২.০ শতাংশ) এই নির্বাচনে অনেক কম ভোটে পড়েছিল। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এই নির্বাচনে মাত্র ২০টি আসন লাভ করেছিল।
১৯৮২ সালের নবম বিধানসভা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৭৭.০ শতাংশ। এই বছর থেকে কিন্তু ভোট গ্রহণের হার অনেকটা বেড়ে যায়। এরপরে আর কোন বিধানসভা নির্বাচনেই ৭০ শতাংশের নিচে ভোট দানের হার নামেনি। এই নির্বাচনে বামফ্রন্ট পুনরায় ক্ষমতায় আসে। মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে তারা ২৩৮টি আসন পায়। পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতির ইতিহাসে এই নির্বাচন কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়, কেন না সিপিআই এই নির্বাচনে বামফ্রন্টের শরিক হিসেবে প্রথমবারের জন্যে অংশগ্রহণ করেছিল। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এই নির্বাচনে পেয়েছিল ৪৯টি আসন।
১৯৮৭ সালের দশম বিধানসভা নির্বাচনে ভোট পড়ে ৭৫.৭ শতাংশ।বামফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল এই নির্বাচনে। মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২৫১টি আসনে তারা জয়লাভ করেছিল। অর্থাৎ, মোট আসনের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী আসন নিয়ে তারা জয়লাভ করেছিল। কিন্তু আগের বারের থেকে ভোটের হার কমে গিয়েছিল ১.৩ শতাংশ। জাতীয় কংগ্রেসের আসন কমে গিয়ে ভাগ্যে জুটেছিল ৪০টি আসন।
১৯৯১ সালেরএকাদশ বিধানসভা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৭৬.৮ শতাংশ ভোট। এই নির্বাচনে বামফ্রন্ট ২৪৫টি আসনে জয়ী হয়ে নিজেদের জয়ের ধারা অব্যাহত রাখে। ব্যয় সংকোচনের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত সময়ের ১ বছর আগেই লোকসভা ভোটের সাথে একই সাথে বিধানসভা নির্বাচন করা হয়েছিল।এই নির্বাচনে আগের বারের থেকে ভোটের হার বৃদ্ধি পেয়েছিল ১.১ শতাংশ। জাতীয় কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দল হিসেবে ৪৩টি আসনে জয়লাভ করেছিল।
১৯৯৬ সালের দ্বাদশ বিধানসভা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৮২.৯ শতাংশ। অর্থাৎ, আগের বারের থেকে ভোটের হার বৃদ্ধি পেয়েছিল ৬.১ শতাংশ। এত বেশী হারে ভোট বৃদ্ধি ১৯৮২ সালের পর আর দেখা যায়নি। মানুষের মনের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে যে একটা ক্ষোভের জন্ম নিচ্ছিল বা অনিবার্য ভাবে বামফ্রন্ট কে যেটার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল, সেটি হল ‘Anti-Incumbency Factor’।এই নির্বাচনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, বামেরা ১৯৭৭ সালের পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনেই ১৯৭২-১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের সন্ত্রাসের অভিযোগের কথা তুলে নির্বাচনে নামত। কিন্তু এই নির্বাচনে প্রথম এমন একটি প্রজন্ম ভোট দেয়, যাদের জন্ম ১৯৭৭ সালের পর অথবা ১৯৭২-১৯৭৭ এর সময়কালে তারা ছিল নিতান্তই শিশু। বামফ্রন্ট আগের থেকেই চিন্তায় ছিল যে, এই নতুন প্রজন্মের ভোটাররা কতটা সেই সন্ত্রাসের কথায় প্রভাবিত হবে? নির্বাচনের ফল ঘোষণা হলে দেখা গেল যে তাদের আশঙ্কা একেবারে ঠিক। নতুন প্রজন্মের কাছে সেই ১৯৭২-১৯৭৭ সালের সন্ত্রাসের কথা আর সেভাবে কাজ করছে না। আগের বারের ২৪৫টি আসন থেকে কমে বামফ্রন্টের আসন দাড়ায় ২০৩ টিতে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস আগের বারের থেকে প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক আসন বাড়িয়ে মোট ৮৩ টি আসন লাভ করে। ১৯৭৭ সালের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই রাজ্যে এককভাবে কোন বিরোধী দলের এটিই সবচেয়ে ভাল ফল হিসেবে গণ্য হয় [যদিও ২০০১ সালে কংগ্রেস (২৬টি) ও তৃণমূল কংগ্রেসের (৬০টি) জোট ৮৬টি আসন পেয়েছিল]।
২০০১ সালের ত্রয়োদশ বিধানসভার নির্বাচনে ৭৫.৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এই নির্বাচনের পূর্বে তৃণমূল কংগ্রেস–কংগ্রেস জোটের পক্ষে একটা তীব্র হাওয়া থাকলেও সে হাওয়া ভোটবাক্স পর্যন্ত পৌছতে পারেনি। বামফ্রন্টের আসন সামান্য কিছুটা কমলেও তাদের সরকার গঠন করতে কোন অসুবিধে হয়নি। মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে ১৯৭টি আসন নিয়ে ষষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। এই নির্বাচনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ১৯৭৭ সালের পর প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসুর অনুপস্থিতিতে বামফ্রন্টের নির্বাচনে লড়া। বামফ্রন্ট বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মুখ করে নির্বাচনী লড়াইতে নেমেছিল।বিরোধী জোটের তরফে তৃণমূল কংগ্রেস ৬০টি ও জাতীয় কংগ্রেস ২৬টি আসনে জয়লাভ করেছিল। আগের বারের তুলনায় ভোটদানের হার কমেছিল ৭.৬ শতাংশ।
২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় চতুর্দশ বিধানসভার নির্বাচন। এই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটদানের হার ছিল ৮১.৬ শতাংশ। অর্থাৎ, ভোটের হার বৃদ্ধি পেয়েছিল ৬.৩ শতাংশ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট পেয়েছিল ২৩৩টি আসন। এই নির্বাচনটি ছিল ত্রিমুখী। একদিকে ছিল বামফ্রন্ট, দ্বিতীয় শক্তি ছিল এনডিএ (ভারতীয় জনতা পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস প্রভৃতি রাজনৈতিক দল) এবং তৃতীয় শক্তি ছিল ইউপিএ (নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস)। এই নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ৩৪টি (পরে উপনির্বাচন মিলিয়ে) আসন ও ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ২৩টি (পরে উপনির্বাচন মিলিয়ে) আসন পেয়েছিল।
১৯৭৭ সালের পর আর যে সালের নির্বাচনটি আমাদের এই লেখার প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হল ২০১১ সালের পঞ্চদশ বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে মোট ৮৪.৭ শতাংশ ভোট পড়েছিল। আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের যে কোন বিধানসভা নির্বাচনে এটিই ছিল সবচেয়ে বেশী ভোটের হার। এই ভোটের পরই দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে চলে আসা বামফ্রন্ট সরকারের পতন হয়। মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২৩৩টি আসন নিয়ে ২০০৬ সালে যখন সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছিল, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন বামফ্রন্ট আরও কয়েক দশক বোধহয় পশ্চিমবঙ্গে থাকবে। কিন্তু ২০০৭ সালের পর থেকেই বেশ কিছু সামাজিক আন্দোলন (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নন্দীগ্রাম–সিঙ্গুর-রিজওয়ানুর রহমান এর মৃত্যুকে ঘিরে আন্দোলন) বামফ্রন্টের ভিত্তি একেবারে নড়িয়ে দেয়। এরই সাথে ছিল সুশীল সমাজের একটি বড় অংশ যারা বরাবর বামফ্রন্টের সাথে ছিলেন, এই সামাজিক আন্দোলন গুলোতে বাম বিরোধী শিবিরের হয়ে গণমাধ্যমে ও রাস্তায় প্রচার করতে নেমে পড়েন। এই নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেস একসাথে লড়াই করেছিল। তৃণমূল শিবিরের শ্লোগান ছিল ‘পরিবর্তন চাই’ আর বামফ্রন্টের শ্লোগান ছিল ‘দু হাজার এগারো-বামফ্রন্ট এবারো’। এই নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ১৮৪টি আসন, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ৪২টি আসন ও বামফ্রন্ট ৬২টি আসন লাভ করেছিল।
২০১৬ সালের ষোড়শ বিধানসভা নির্বাচনে ৮৩.০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। অর্থাৎ, ভোটের হার কমেছিল ১.৭ শতাংশ। এই নির্বাচনে পরিবর্তনের কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। যদিও ভোটের আগে বাম-কংগ্রেস জোট বেশ জোরালো হাওয়া তুলেছিল, কিন্তু ভোটের ফলাফল বেরোলে দেখা যায় তৃণমূল কংগ্রেসের দ্বিতীয় বারের জন্যে সরকার গঠন করতে কোন অসুবিধেই হচ্ছে না। মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে তারা লাভ করে ২১১টি আসন। এই নির্বাচনও ত্রিমুখী ছিল। একদিকে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, অপরদিকে বাম-কংগ্রেস জোট এবং তৃতীয় শক্তি হিসেবে ছিল ভারতীয় জনতা পার্টি। বাম-কংগ্রেস জোট পেয়েছিল ৭৬টি আসন। বামেরা ৩২টি ও জাতীয় কংগ্রেস ৪৪টি আসন লাভ করেছিল। ভারতীয় জনতা পার্টি পেয়েছিল ৩টি আসন।
এবারে আমরা চলে আসি এবারের ২০২১ সালের সপ্তদশ বিধানসভার নির্বাচনের ভোটদানের বিষয়ে। এবারের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন ত্রিমুখী। একদিকে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, অপরদিকে ভারতীয় জনতা পার্টি এবং তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আছে বাম-কংগ্রেস-ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টকে নিয়ে গঠিত সংযুক্ত মোর্চা। এদের মধ্যে আসল লড়াই অনুষ্ঠিত হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্যে। তবে বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হলে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ বছরের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের হার ৮১.৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ, ১.৩১ শতাংশ ভোটের হার কমেছে গত বারের চেয়ে। সাদা চোখে দেখে মনে হচ্ছে সরকারের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। কারণ, ২০১১ সালের বিখ্যাত ‘পরিবর্তন’ সহ ১৯৬৭ সালের পরিবর্তনেও কিন্তু আগের নির্বাচন গুলো থেকে ভোটদানের হারের বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়, বিশেষ করে ১৯৬৭ সালে তো ভোট বৃদ্ধির হার ছিল ১০.৫ শতাংশ। ১৯৬৯ সালের পরিবর্তনেও ০.৪ শতাংশ বৃদ্ধি ছিল। অর্থাৎ, খুব সামান্য হলেও ভোটের হারের বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছিল। এমনকি ১৯৯৬ সাল, যখন ‘Anti-Incumbency Factor’- এর কারণে সরকারের বিরুদ্ধে বিরাট ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, প্রধান বিরোধী দলের আসন সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, তখনও আগের বারের নির্বাচন থেকে ভোটদানের হার বেড়ে গিয়েছিল ৬.১ শতাংশ। কাজেই এই নির্বাচনে যেখানে ভোটের হার গত বিধানসভা নির্বাচন থেকে ১.৩১ শতাংশ কমে গেল, সেখানে স্থিতাবস্থা বজায় রাখারই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যদি না ১৯৭৭ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটে।
লেখক, বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক